করোনাক্রান্ত পৃথিবীর এই কালবেলায় স্তব্ধগতি জীবনে স্থবির থেকে থেকে আমরা ক্লান্ত। রুদ্ধ জীবনে মনে হচ্ছে মৃত্যুই যেন একমাত্র সত্য। বিপুলা এই পৃথিবীতে পথ চলতে চলতে যিনি আত্মস্থ করেছেন এই অমোঘ শিক্ষা - আমাদের পথ চলা একদিন থেমে যায়, জীবন থামে না। জীবনের পথ চলা যখন প্রায় থেমেই আছে, এই অভিশপ্ত সময়কেই তিনি জীবনের সীমান্ত অতিক্রম করে মৃত্যুর শীতলতাকে বরণ করার জন্য বেছে নিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। গতকাল ১৪ মে, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। কী আশ্চর্য ! ঢাকায় মহীরুহের পতন ঘটল অপরাহ্নে । আর রাতে শালপ্রাংশু ভূপাতিত হল কলকাতায়। করোনাক্রান্ত মলিন পৃথিবীকে বিদায় জানালেন দেবেশ রায়ও । দুই বাংলার দুই মহানগরীতে একই দিনে দুই মহীরুহের মহাকালের মহাপথে যুগপৎ প্রত্যাগমন ।
বাঘারুর স্রষ্টা সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের জন্ম অবিভক্ত বাংলার পাবনায় ১৯৩৬ সালে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আবির্ভাব ১৯৩৭ এ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে। খুব বড়মাপের মানুষ গুলো । জীবনসাগরের অতলে ডুব দিয়ে মণিমুক্তো তুলে আনা জহুরীরা একে একে আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছেন। সময়কালেই বিদায় নিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যার যেমন বলেছেন, আমাদের পথচলা একসময় থেমে যায় , জীবন থামে না। বাঙালির জীবনে , বাঙালির যাপনে এইসব জহুরীদের স্থান পূর্ণ হচ্ছে কী ? অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই অসাম্প্রদায়িক, উদার এবং ধর্মীয় অন্ধত্বমুক্ত বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে তিনি ছিলেন চালকের আসনে। মৌলবাদের সমালোচনায় তিনি ছিলেন আমৃত্যু নির্ভীক। ভয় পেয়ে মনের কথা মুখেই চেপে যান নি কদাপি। বাংলাদেশে এমন উদারচিত্ত , নিঃশঙ্কচিত্ত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান । অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পরম সুহৃদ । যেই অভিভাবকদের পায়ের কাছে বসলে আজও মনে হয় বাঙালির শেকড় এক ও অভিন্ন । তাঁদেরই একজন আনিসুজ্জামান। আমাদের মাথার উপর থেকে অভিভাবকদের হাত গুলো একে একে উঠে যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটের আনিসুজ্জামান বিদায় নিলেন বাংলাদেশের ঢাকায় । বাংলাদেশের পাবনার বাগমারার দেবেশ রায় অস্তাচলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। দেশভাগ ঘরের মানুষকে পর করেছে। এ আর নতুন কথা কি । দেবেশ রায় মানেই উত্তরবঙ্গ। দেবেশ রায় মানেই তিস্তা পারের বৃত্তান্ত। দেবেশ রায়ের প্রস্থানের পর কিংবদন্তি শব্দটার ভার বহন করার মতো পাত্র বাংলা সাহিত্যে আর আছে বলে মনে হয় না। জন্ম পাবনায় হলেও সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের কৈশোর-যৌবন কেটেছে তিস্তা পারের শহর জলপাইগুড়িতে। তরাই-ডুয়ার্সের মানুষকে নিজের হাতের তালুর মতোই চিনতেন । উত্তরবঙ্গের জল-জঙ্গল-জনপদের গহীনে মিশে গিয়ে তুলে এনেছেন পরম ঐশ্বর্য। যার আখ্যান ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ আছে এপিক উপন্যাস তিস্তা পারের বৃত্তান্তে । বাঘারুকে না জানলে তিস্তা-তোর্ষা-কালজানি-রায়ডাকের পাড়ের মাটির সন্তানদের জীবনগীত আপনার অশ্রুতই থেকে যাবে ।
লেখক পেশায় সাংবাদিক। রাজনৈতিক ভাষ্যকার । দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরণের গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত । নেশা লেখালেখি।
No comments:
Post a Comment